মহালয়ার আগেই পুজো শুরু! জানেন কোথায়?

 পশ্চিম মেদিনীপুরের চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো আর পাঁচটা পুজোর থেকে বেশ আলাদা

Durgapuja, Durgatsab, World heritage, Sabeki puja, Lord Durga
ছবি: তৃণা চৌধুরী 

তৃণা চৌধুরী : ঢাকে কাঠি পড়ে গেছে। আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা। মহিষাসুরমর্দিনী মা দুর্গা বাড়ির মেয়ে হয়ে ঘরে ফিরবেন আর পাঁচ দিনের উৎসবে মুখরিত হবে বাংলা। বাঙালির তেরো পার্বণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এই দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর ভাষায় হেরিটেজ তকমা পেয়েছে ২০২১ সালে। দেশ তথা বিশ্বের মানুষ এই উৎসব নিজের মত করে নিয়েছেন। যদিও দুর্গোৎসবের পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গে পুজোর দিনগুলোতে একটা অন্য আমেজ ছড়িয়ে যায়। আকাশে বাতাসে, শিউলি, কাশে আগমনীর সুর ভেসে বেড়ায়।
আলোঝলমলে রাজধানী কলকাতা যেন রূপকথার শহর হয়ে ওঠে এই কয়েকদিন। থিম আর সাবেকিয়ানা পুজোর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, রাত জেগে ঠাকুর দেখা, কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি। তবে শহর বা মফঃসলের আকাশছোঁয়া বাজেটের থিম কিংবা মানুষের ভিড় যদি আপনি এড়িয়ে চলতে চান তাহলে আপনাকে ঘুরে দেখতে হবে বাংলারই কিছু বিশেষ এবং অন্যরকমের পুজোগুলি। আজকে সেরকমই একটি পুজোর খোঁজ থাকল আপনাদের জন্য।
এই পুজোর স্বাদ পেতে কলকাতা ছাড়িয়ে আপনাকে পৌঁছতে হবে পশ্চিম মেদিনীপুর। পশ্চিম মেদিনীপুরের এই গ্রামটির নাম রঞ্জপুর। ছোট, শান্ত ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরা এই গ্রামে বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারের নিজস্ব দুর্গাপুজো। আর পাঁচটা সাবেকি পূজোর মত হলেও ইতিহাসে এবং পুজোর নিয়ম নীতি অনুসারে এই পুজো অনেকটাই আলাদা।

Durgapuja, Durgatsab, World heritage, Sabeki puja, Lord Durga
ছবি: তৃণা চৌধুরী 

কথিত আছে বর্ধমানের কােনো একজন সমৃদ্ধশালী রাজা কােনো এক সময়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের এই এলাকায় কিছু অংশ নিজের দখলে আনেন। পরে জমিদার এখানে নিতান্তই বেড়াতে আসেন এবং জায়গাটি তার ভালো লাগে। বলা হয় তার উদ্যোগেই এই গ্রামে দুর্গা এবং দামোদর মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। মন্দিরে নিত্যপুজো, মন্দির রক্ষণাবেক্ষন এমনকী দুর্গাপুজোর দায়িত্ব নাকি এই অঞ্চলের সরকার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সাম্মানিক হিসাবে চৌধুরী উপাধিও দেওয়া হয় সরকার পরিবারকে। মন্দিরের এবং দুর্গাপুজোর খরচে যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেই কারণে এখানে সরকারি দেবত্তোর ট্রাস্টের অন্তর্ভুক্ত বেশকিছু জমিজমা জলাশয় পুকুর ইত্যাদি আছে। ওই আয় থেকেই এখনও পুজোর খরচ চালানো হয়।
যদিও সচেতনতার অভাবে এই বাড়ির পুজো ঠিক কত বছরের তার সঠিক হিসেব হারিয়ে গেছে। কোন সময়ে ঠিক কোন রাজা বা জমিদারের সময়ে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা জানা যায়না। বেশ কয়েক বছর আগে দামোদর মন্দির সারানোর সময়ে মন্দিরের চূড়ার অংশ থেকে একটি শ্বেতপাথরের ফলক পাওয়া যায় বটে কিন্তু  তাতে থাকা অস্পষ্ট লেখা পড়া সম্ভব হয়নি। অনেকে মনে করেন ওই ফলকটিতে পুজো শুরুর সময় সম্পর্কে কোনো তথ্য থাকতে পারে। যদিও এই পুজো যে বেশ প্রাচীন তা বোঝা যায়।

Durgapuja, Durgatsab, World heritage, Sabeki puja, Lord Durga
ছবি: তৃণা চৌধুরী 

বর্তমানে এই পুজো দুটি ভাগে বিভক্ত। অবশ্য দুটি পুজোই চৌধুরী পরিবারেরই। বেশ কিছু প্রজন্ম আগে পারিবারিক কিছু সমস্যায় পুজো আলাদা করে নেওয়া হয়। চৌধুরী পরিবারের একাংশ এবং তাদের দৌহিত্র রায় এবং ঘোষ পরিবার মূল পুজোটি তত্ত্বাবধান করেন এবং অন্য পুজোটি চৌধুরীদেরই অপর অংশের উদ্যোগে হয়।
সাধারণভাবে দুর্গাপুজোয় যে সমস্ত নিয়ম মানা হয়, এখানে সেসব কিছু নিয়ম বেশ অন্যরকম। যেমন, জন্মাষ্টমীর শুভ দিনে পুরোনো বছরের কাঠামোয় মাটি লাগিয়া নতুন বছরের দুর্গোৎসবের সূচনা করা হয়। এই বাড়ির মায়ের মূর্তি চতুর্ভুজা। দশভুজা নয়। মা দুর্গার সাধারণ যে গায়ের রং সব জায়গায় দেখা যায় এখানে তেমন না, বরং মায়ের রং এখানে তপ্ত কাঞ্চন, শিউলি ফুলের বোঁটায় যে রং থাকে সেটি। দুই প্রতিমার একটিতে রূপোলি ও অন্যটিতে সোনালি সাজ পরানো হয়। পুজো শুরুর আগে ঘরে নিজেদের হাতে বানানো বিভিন্ন রকমের নাড়ু, মুড়কি ইত্যাদি পুজোর ভোগে দেওয়া হয়। দামোদরের ভক্ত, তাই এখানে বাড়ির ভিতর মুরগীর মাংস নিষিদ্ধ এবং কোনো বাড়ির সীমানায় পাঁচিল তোলাও নিষিদ্ধ যাতে বাড়ি থেকেই মন্দিরের চূড়া সবসময় দেখা যায়।

Durgapuja, Durgatsab, World heritage, Sabeki puja, Lord Durga
ছবি: তৃণা চৌধুরী 


Durgapuja, Durgatsab, World heritage, Sabeki puja, Lord Durga
ছবি: তৃণা চৌধুরী 

এই পুজোর অন্য একটি বিশেষ নিয়ম হল মহালয়ারও আগে জিতাষ্টমীর দিন থেকে মন্দিরে নিয়মিত চন্ডীপাঠ শুরু হয়ে যায় এবং বাড়ির সদস্যরা সকলেই এইসময়  নিরামিষ খাবার খান । মহাদশমী অবধি এই নিয়ম চলে। মূলত পুজোয় তিন জন পুরোহিত থাকেন। একজন মুখ্য পুরোহিত, একজন তন্ত্রধারক এবং পরিবারের কুলগুরুদেবের বংশধর উপস্থিত থাকেন।
পুজোর দিনগুলোতে দামোদরও দুর্গা মন্দিরে পুজিত হন। মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যেয় বেলবরণের পুজো করে মূল উৎসব শুরু হয়। মহাসপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নান, এবং চক্ষুদান না হওয়া অবধি বাড়িতে উনুন জ্বালানো যায় না। এখানে ছাগবলীর প্রথা আছে। মহাসপ্তমী ও নবমীতে বলি হয় তবে মহাষ্টমীর দিনে বলি হয় সন্ধিপুজোর সময়ে। সন্ধিপুজোর সময়ে ১০৮ টি পদ্ম এবং ১০৮টি প্রদীপ স্তম্ভের আরতি এখানে আর্কষণীয়। দশমীর দিনে না, বরং সন্ধিপুজো শেষে এখানে সিঁদুর খেলার নিয়ম রয়েছে। মহানবমীতে বাড়ির সমস্ত পুরুষেরা পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে মায়ের মন্দিরে দক্ষিণান্ত করেন। সপ্তমী পুজো থেকে দশমী অবধি হোমের আগুন একটানা জ্বালিয়ে রাখতে হয়। দশমীর সকালে দর্পণ বিসর্জন দিয়ে মূল উৎসব শেষ হয়। সন্ধ্যেয় প্রতিমা বিসর্জন হয়।
আরও একটি বিশেষ ব্যাপার হল পুজোর সঙ্গে যুক্ত সেবায়েত, ঢাকি, প্রতিমা শিল্পী সকলেই বংশপরস্পরায় এই পুজোর কাজের সঙ্গে যুক্ত। এইভাবে শহরের আলো, কোলাহল, ভিড়ের বাইরে ছোট পরিসরে অসাধারণ একটি দুর্গাপুজোর সাক্ষী হয় গ্রামবাংলা। 


0/Post a Comment/Comments

নবীনতর পূর্বতন