তন্ময় সামন্ত: প্রতিটি ধ্বংসের মধ্যে একটি সৃষ্টির বার্তা থাকে। প্রতিটি বিপর্যয়ের মধ্যেই থাকে একটি ইঙ্গিত। সাবধানতার। সূচনার। চোখে দেখা যায় না যাদের তারাই আজ চোখে আঙুল দিয়ে বিশ্বের মানবজাতিকে অনেক কিছু দেখিয়ে দিল। কেড়ে নিল অনেক কিছু। কিন্তু ফিরিয়ে দিয়ে গেল হয়তো অনেক বেশি।
গতকাল সন্ধ্যায় ফেসবুক নোটিফিকেশনে একটি ভিডিও। আমাদের শহর কলকাতার। একটি রাস্তা - যেখানে ট্রাফিক সামলাতে হিমশিম খেতে হতো পুলিশকর্মীদের। আজ জনমানব শূন্য সেই রাস্তায় গোধূলির আলোতে হাততালি দিয়ে দিয়ে গান করছে পুলিশ কর্মীরা। আর সেই রাস্তার চারপাশে বহুতল বাড়ির বারান্দা, আকাশচুম্বী অট্টালিকার ব্যালকনি, জানালা থেকে মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে সঙ্গত দিচ্ছে মানবতা। মানবিকতা নেই বলে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, সমাজের একাংশ যাদের মানুষ বলেই মনে করে না, মনের রাগ হিংসা মিটিয়ে নিতে যাদের উপর যখন তখন আক্রমণ করা যায় সেই উর্দিধারীরা আজ রাজপথে। আইন রক্ষার্থে নয়। মানব জাতিকে রক্ষার জন্য। সচেতনতার জয়গান গেয়ে পাশে থাকার ইঙ্গিত। করোনা না এলে এই দৃশ্য কি কোনদিন দেখতে পেত তিলোত্তমা?
নোটিফিকেশন ২। কর্পোরেট অফিসে চাকুরিরতা তিতলি। আট বছর আগে সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া মেয়েটি ভালবেসে বিয়ে করেছিল অফিসের সিনিয়র সুমনকে। সে আজ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। নাইট ডিউটি। তিতলি যখন অফিস থেকে ফেরে সুমন তখন অফিসে। তাই সপ্তাহে ছুটির দিন ছাড়া দুজনের আর এক ছাদের নিচে থাকা হয়না। দুজনের আজ work-from-home। কাজের ফাঁকে একসঙ্গে খাবার বানাচ্ছে। একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার। বিয়ের পর প্রথমবার তারা বিয়ের অ্যালবাম খুলে বসেছিল। একসঙ্গে। এক অবসরের বিকেলে। পুরনো ফাইল ঘেঁটে তিতলির ক্লাস ফাইভ এর মার্কশিট বের করেছে সুমন। আলমারি গোছাতে গিয়ে সুমনের কবিতার খাতা খুঁজে পেয়েছে তিতলি। প্রথম প্রেম, প্রথম ক্রাশ, সব পর্দা ফাঁস। কত খুনসুটি, মজা।
নোটিফিকেশন ৩। চলচ্চিত্র জগতের নামজাদা নায়িকা। যাকে দেখলে আট থেকে আশি সবার মনে শিহরণ জাগে। যাঁর একটা ডেট পেতে গেলে পরিচালককে অপেক্ষা করতে হয় ৬ মাস। তাঁর নিজস্ব ভ্যানিটি ভ্যান, ৪ জন সিকিউরিটি গার্ড, দুজন পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। তিনি লাঞ্চে কী খাবেন শুধু এটা জানার জন্যই সদাব্যস্ত একাধিকজন। আজ সবার ছুটি। তাই স্বামী, সন্তান যাতে কিছু খেতে পারেন তার জন্য ইনি রান্না ঘরে। বাধ্য হয়েই বাসন মাজতে হচ্ছে, ঘর মুছতে হচ্ছে। আবার ফেসবুকে পোস্ট করছেন সেই ভিডিও।
নোটিফিকেশন ৪। পাড়ার ছোট্ট গোগোল ছিল সবার নয়নের মণি। কী মিষ্টি ব্যবহার। চেহারাও। ভালো বাঁশি বাজাতো। তাই গোগোল হয়ে উঠেছিল গোপাল। সেই গোপাল ওরফে আদিত্য সুন্দর রায় আজ এক নামজাদা মার্কিন কোম্পানির সিইও। থাকেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। তবে এক মাস হল ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে। অনলাইনে কিছু মিটিং করতে হচ্ছে। বাকি সময়টা ফ্রি। বই পড়ছেন। টিভি দেখছেন সপরিবারে। মার্কিন দেশে বড় হয়ে ওঠা ছোট্ট ছেলেকে ছোটবেলার অ্যালবাম দেখাচ্ছেন। আর মাঝে মাঝে বয়স্ক মায়ের পাশে বসে তাঁর ছোটবেলার গল্প শুনতে শুনতে মনটা উদাসীন হয়ে উঠছে। সেই উদাসীন মনেই পুরনো বাঁশিটা খুঁজে নিয়ে উঠে গিয়েছিলেন ছাদে। সুর এলো। স্মৃতিও।
নোটিফিকেশন ৫। ১৫ বছর বিয়ে হয়েছে অমৃতার। সম্বন্ধ করে। পারিবারিক ব্যবসা। ট্রান্সপোর্ট-ইমপোর্ট এর। অমৃতার গানের গলা শুনে পছন্দ করেছিল সজল। বাসর ঘরে সজলের গিটারের সুরে গানের ঝড় তুলেছিল আমৃতা। তারপর? সজল ব্যবসায়, অমৃতা সংসারে। সাজানো-গোছানো বাড়ি, দামি গাড়ি, সন্তান সবই আছে। দামি গহনা, শাড়ি, পছন্দের জিনিস চাওয়ার আগেই পেয়ে গেছে অমৃতা। শুধু দুজন দুজনকে চেনা হয়ে ওঠেনি। এখন ব্যবসা বন্ধ। চিন্তায় সজল। তবুও সেদিন একপ্রকার জোর করেই তার হাতে গিটারটা ধরিয়ে দিল ছোট্ট বাবাই। বেসুরো গিটার সুর এল অল্প সময়েই। গেয়ে উঠল অমৃতা। গলা মেলালো বাবাইও। এত আনন্দিত, এত উৎফুল্ল বাবাইকে আগে কেউ দেখেনি। সেদিন অনেক রাতে নিদ্রাহীন বিছানায় অমৃতা সজলের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, 'আমাকে দিয়েছো অনেক কিছু। কিন্তু আজ আমি পূর্ণ হলাম। তাই আমার সব কিছু উজার করে তোমায় দিলাম।' ...এখন প্রতিদিন ব্যালকনিতে সুরেরা খেলা করে।
প্রতিদিন ইতিহাস লেখা হয়। কিন্তু যুগের সৃষ্টি হয় না। আজ আমরা একটা যুগের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। কোন সন্ধিক্ষণই চিরস্থায়ী নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি, আর আমাদের সমগ্র প্রচেষ্টায় এই সন্ধিক্ষণকে কাটিয়ে উঠবো আমরা। খুব শীঘ্রই। আমরা সবাই সেই জীবাণুমুক্ত ভোরের স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি প্রাণোচ্ছ্বল পৃথিবীর। সেই করোনা পরবর্তী যুগে প্রথম আলোর চরণধ্বনি যখন এসে পড়বে আমাদের আঙিনায় তখন আমরা আমাদের এই প্রাণসত্তাকে মনে রাখব তো? না আবার পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়াবে যান্ত্রিক মানবতা?