ভূলুণ্ঠিত বিদ্যাসাগরের মূর্তি, কয়েকটি রাজনৈতিক প্রশ্ন

তন্ময় সামন্তঃ বিদ্যাসাগর। বাঙলার আবেগ। বাঙালির। সেই আবেগে হাত পড়লে  বাঙালি যে ছেড়ে কথা বলবে না এটা ভালোমতোই জানতেন তৃণমূল নেতৃত্ব।  তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে দেওয়ার ঘটনাকে তুরুপের তাস করে ফায়দা তুলতে মাঠে নেমে পড়লেন তৃণমূল সুপ্রিমো। বাদ নেই বামেরাও। স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনায় কাঠগড়ায় বিজেপি। ঘটনা অবশ্যই নিন্দনীয়। কড়া নিন্দা করছেন পশ্চিমবঙ্গের বিদ্বজনেরা। ধিক্কার দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। দেওয়াটাই স্বাভাবিক। 
গতকাল রাতেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। আগুন জ্বালানো হয়েছে। বিহার-রাজস্থান থেকে গুন্ডা এনে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। নিন্দার ভাষা নেই।'' এদিকে আজ বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, "বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হচ্ছে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে। কিন্তু কলেজের ভিতরে কারা ছিল? মূর্তি ছিল ঘরের ভিতর। তা হলে তালা খুলল কে?'' 
প্রশ্ন উঠেছ এখানেই। তিনি বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি। দিল্লি থেকে কলকাতায় উড়ে এলেন মিছিল করতে। চমক দিতে আড়ম্বর কম ছিল না। খরচ করলেন ঢালাও অর্থ। কিন্তু মিছিল করার আগে একবারও তিনি পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবেন না এটা কী করে হয়? তাঁর কাছে আইবি-র রিপোর্ট থাকবে না এটা কী করে মেনে নেওয়া যায়? বিদ্যাসাগর কলেজে হঠাৎ করে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের লোকেরা জমা হয়ে যায়নি। সব কিছু প্ল্যান মাফিকই হয়েছে। তাহলে সেই খবর পেয়ে মিছিলের পথ বদল করলেন না কেন? আর আগাম খবর যদি নাই থাকে, তাহলে আইবি-র দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে? তুমি তৃণমূলের গড়ে এসে চমক দেবে। আর দলের লোকজন বসে বসে হাততালি দেবে? - এতটা বোকা কি অমিত শাহ? 

গোলমাল হতে পারে এমন ভাবাটাই তো স্বাভাবিক। সূত্র বলছে, আগাম খবরও ছিল। স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের তরফ থেকে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল যে, তৃণমূল সমর্থকেরা বিধান সরণি এবং কলেজ স্ট্রিটে রোড শোয়ের রুটেই অমিত শাহকে কালো পতাকা দেখিয়ে বিক্ষোভ দেখাবেন এবং এই বিক্ষোভ মূলত র‌্যালি রুটের উপরে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই হবে। তেমনই বিজেপি সেল থেকেও রিপোর্ট দিয়ে স্পষ্ট জানানো হয়েছিল, এই বিক্ষোভের পাল্টা প্রতিরোধের জন্যও প্রস্তুত থাকবে বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা। তাহলে তো এটা স্পষ্ট হয়ে যায় ঘটনার দায় বিজেপির। তা যদি না হবে তাহলে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়নি কেন? বিজিপির তরফ থেকে এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে, মিছিলের মধ্যে বিরোধী দলের লোকজন ঢুকে গিয়ে গোলমাল পাকিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলের সর্বভারতীয় সভাপতির মিছিলে কারা কারা থাকছে তার তথ্য দলের কাছে থাকবে না? মিছিলে কারা হাঁটছেন, তাঁদের কী উদ্দেশ্য সেটা তো খতিয়ে দেখা উচিত। দলের স্থানীয় নেতারা কী করছিলেন? দলের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব তো তাঁদেরই।  বাইরে থেকে যখন লোকজন নিয়ে আসছো তারা কে কী চাইছে, কী করছে তার লাগাম তো দলের নেতাদের কাছেই থাকা দরকার। তৃণমূল প্ররোচনা দেবে, আর বিজেপি-সমর্থকেরা সেই প্ররোচনায় পা দিয়ে হাঙ্গামা বাঁধাবে? এই বুদ্ধি নিয়ে তোমরা দেশ চালাচ্ছো? দলের কর্মীদের উপর এটুকু নিয়ন্ত্রণ নেই?  

তাবলে তৃণমূলকেও দরাজ সার্টিফিকেট দেওয়া যায় না। রাজ্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাজ্য পুলিশের। রাজ্য নিরাপত্তা বাহিনী গোলমাল নিয়ন্ত্রণ করতে যদি না পারে, তাহলে সেই ব্যর্থতা রাজ্যেরই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আজ আপনি গলা ফাটাচ্ছেন, 'কোনও রাজনৈতিক দলের এ-রকম হাঙ্গামা কখনও দেখিনি। বিহার-রাজস্থান থেকে গুন্ডা এনে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে।' আপনার দলের ছাত্রনেতারা কী ওখানে অমিত শাহের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়েছিলেন? বলছেন, পুরো এলাকা তছনছ করার জন্যও অভিযুক্ত বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা। তাহলে রোড শো শুরুর আগেই বিজেপির পোস্টার-ফেস্টুন খুলে ফেলতেও কি বিজেপি ভিনরাজ্য থেকে লোক ভাড়া করে এনেছিল? যখন পাথর, জলের বোতল ছোঁড়া হচ্ছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী কী করছিল? সূত্র বলছে, স্পর্শকাতর বিদ্যাসাগর কলেজের সামনে কোনও পুলিশি প্রহরাই ছিল না? কিন্তু কেন? তাহলে কি মুখ্যমন্ত্রী এই গোলামালটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন? মঙ্গলবার অমিত শাহের রোড শো-কে কেন্দ্র করে যে এই ধরনের গন্ডগোল-অশান্তি হতে পারে, তা আগে থেকেই পুলিশকে সতর্ক করেছিল কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ। অর্থাৎ ভিতরে ভিতরে যে এত বড় একটা সংঘর্ষের আবহ তৈরি হয়েছে, স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের রিপোর্ট অনুযায়ী সেটা খুব ভাল করেই জানতেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা। তা সত্ত্বেও গোটা সময় অমিত শাহের মতো এমন একজন ভিআইপি নেতার রোড শোয়ে পুলিশকে কড়া হতে দেখা গেল না। বিক্ষোভকারীদের আগে থেকে ছত্রভঙ্গও করা হল না।  
সুতরাং এটা বলতেই হবে কাল যে নোংরা রাজনীতি কলকাতা দেখল, তার যেমন দায় বিজেপির, তেমনি তৃণমূলের। 

0/Post a Comment/Comments

নবীনতর পূর্বতন