মহাকালের ঘণ্টা বাজছে, মায়ের ছবিতে মালা


সময় বদলায়। বদলাবেই। নিয়নের আলো ফিকে হয়ে এলইডি'র উজ্জলতায়। স্মার্টফোন মাপে রক্তচাপ। মুহূর্তগুলো বন্দি আজ আঙুলের ছোঁয়ায়। তবু ছুটির দিনে ক্লান্ত দুপুরে ভাতঘুম মন। শিরিষ গাছের দীর্ঘ ছায়া আড়মোড়া ভাঙে তপ্ত ছাদে। আর মন কেমন করা রবিবার দুপুরে মজে থাকে 'রোদ্দুরের কথকতা'। 

কলমে-দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়


-তোমার সঙ্গে কবে যেন দেখা হয়েছিল?

-৪ঠা অথবা ৫ই ডিসেম্বর।

-কল্যানী অথবা কামস্কাটকায়।মেমারী অথবা মাদাগাস্কারে। কোথায় যেন?

-চেরী গাছের তলায়।ইউনিট ২ স্কুলে।

-পেন হসপিটালের সামনে? চন্দননগর স্ট্যান্ডে? নাকি? মনে আছে সেই কলেজ স্ট্রীট, কফিহাউস।

-ধ্যাত, আগেও তো কতবার দেখেছো। ওকি একটা মনে রাখার মত বিষয়।



-আরে না না। সে এক অন্যরকম দেখা। শীতরাতের ঠান্ডা ছুরি কেটে দেওয়া আবহাওয়া পেরিয়ে -মৃদু মোমের আলোয় যৌথ যাপন। বলো কি দুর্দান্ত স্মৃতি।

-তোমার জন্মদিনটা খালি ভুলে যাই; ১৮ই বৈশাখ? শ্রাবণ? ২রা মে? না না ওটা নয়।পয়লা মে সংগঠনের জন্মদিন। মনে নেই তোমার?

-ওটা মায়ের জন্মদিনে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

-ঠিক ঠিক। কিন্তু ছেলেটা তোমার যেন কবে? মহালয়ার দিন না চড়কের দিন?

-সব ভুলে মেরে দিয়েছো? মহালয়ায় বড়দি। ৯ই মে দাদা। চড়কের গায়ে গায়ে ছেলেটা। ২৩শে শ্রাবণ বাবা।

-রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একটা যোগ আছে না?

-তোমার বাংলা ইংরাজী গুলিয়ে গেছে। আরে রবীন্দ্রপ্রয়াণ ২২ শে।



-এই একটা কথা বলো তো? এত তারিখ জেনে কি করবে?

-বা রে উদযাপন করতে হবে না? এইসব দিন গুলোই জীবনের মাইলফলক।

নতুন জামা কাপড় পরে আসনে বাবু হয়ে বসতাম। কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে ধান দুব্বো দিয়ে মা আশীর্বাদ করতেন। রুপোর বাটিতে পায়েস মিষ্টি খাওয়াতেন। জন্মদিন সবারই স্পেশাল। আসলে দিন মাস বছরের এই হিসেব স্মৃতিকে সংরক্ষণ করার প্রয়াস বই তো কিছু নয়।

এই যেমন ধরো পয়লা মে। সেই কবে ১৮৮৬ সালের অন্যরকম শিকাগো শহরে তার হাজারো কুখ্যাতি নিয়ে নিজের মতো করে দিন কাটাচ্ছিল। আমেরিকার অন্যতম শিল্পশহর। যেখানে প্রচুর জার্মান ও বোহেমিয়ান অভিবাসীরা শ্রমিক হিসাবে কাজ করত। একদিকে মাদক চোরাচালান ও গুণ্ডাদের আখড়া অন্যদিকে শ্রমিকদের উপর অকথ্য অত্যাচারসহ প্রায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রমসাধ্য কাজ।

৪ঠা মে হে মার্কেট স্কোয়ারে দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবীতে হরতাল ও শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর বোমাবাজি। ফলতঃ পুলিশের মৃত্যু শ্রমিকের মৃত্যু সাধারণ পথচারীর মৃত্যু। সব মিলিয়ে ব্যাপক শোরগোল ধরপাকড়। জেল ফাঁসি। প্রবল জনসমর্থন সূচনা করে বিপ্লবের। সর্বহারাদের সম্মিলিত দাবী ও বিশ্বশান্তির উদ্দেশ্যে আইনসিদ্ধ হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পয়লা মে।

মা জন্মেছিলেন এই দিনে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর অনেক দেরি করে খাবার খেতেন। সংসার পাকে পাকে জড়িয়ে রেখেছিল তাঁকে। উপবাস, পরিবারের সদস্যদের জন্য কল্যাণকামনা ও আরও নানা উপাখ্যানের মধ্যে তাঁর নিজের ভাল থাকাটাই গৌণ হয়ে গিয়ে ছিল। মায়ের জন্মদিনে পায়েস হয়নি মনে হয় কোনোদিন। তাই হয়তো চলে গিয়েছেন অকালে অভিমানে।

আটঘন্টার সুবিধা তিনি পাননি। আমরা পেতে দিইনি। আজও চোখ বুজলে দেখতে  পাই সেই মিছিলে পতাকা হাতে সামনের সারিতে মা হাঁটছেন। মেয়েরা এইভাবেই হেঁটে যায় চিরকাল। বিপ্লবের সেবাদাসী হয়ে।

আমরা সুবিধা নিতে শিখেছি খুব। সেই ব্যাটনটা যে অন্যকে এগিয়ে দিতে হয় এই বোধ আর কবে জাগবে? আমরা হুকুম করতে শিখেছি বাড়িতে। পেয়ে পেয়ে অধিকার মনে হয়ে গেছে যত্নকে। বাড়ির মানুষজনের ও একটু যত্ন একটু শুশ্রূষা প্রয়োজন, মনে থাকে না আমাদের।


আজ মা নেই। একটু সচেতন হলে আরো বেশ কিছুদিন একসঙ্গে থাকা যেত। এক বিরাট বিপুল বিষন্নতায় ভরে যাচ্ছে চরাচর। শুধু দিনগোনা। শেষের সে দিন ভয়ংকর। বাঁচতে হলে পাশাপাশি ফুটে ওঠা রক্তগোলাপের মতো বাঁচো। একে অন্যকে পিষে দিয়ে চেপে দিয়ে ছোট করে নয়।

মহাকালের ঘণ্টা বাজছে। শুনতে পাচ্ছো কি? অথচ এখন ছবিতে মালা। ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে যায়। নিজের মেধা দক্ষতা যোগ্যতা শিক্ষকতা সব জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁর এই আত্মবলিদান আমাকে বারবার বিষণ্ণ অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। আবার ফিনিক্সের মতো জেগে উঠি তাঁর হাসিমুখ আর অভয়দাত্রী প্রতিমা দেখে ।।



0/Post a Comment/Comments

নবীনতর পূর্বতন