জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে

সময় বদলায়। বদলাবেই। নিয়নের আলো ফিকে হয়ে এলইডি'র উজ্জলতায়। স্মার্টফোন মাপে রক্তচাপ। মুহূর্তগুলো বন্দি আজ আঙুলের ছোঁয়ায়। তবু ছুটির দিনে ক্লান্ত দুপুরে ভাতঘুম মন। শিরিষ গাছের দীর্ঘ ছায়া আড়মোড়া ভাঙে তপ্ত ছাদে। আর মন কেমন করা রবিবার দুপুরে মজে থাকে 'রোদ্দুরের কথকতা'। 

কলমে-দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়



এক জীবনে মহাজীবনের উপলব্ধি পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি। মহাকাব্যিক উপমা তাঁর সারা জীবন চর্যায় মিশে আছে। একটা উদাহরণ হয়ে ওঠার সচেতন তাগিদ তিনি ছোটোবেলা থেকেই অনুভব করতেন। আমাদের ক্লাবে তৎকালীন সচিব ২৫শে বৈশাখের ভাষণে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপ্তি নিয়ে বলতে গিয়ে বলে ফেলেছিলেন তিনি একটা জিনিস ছিলেন। তখন খুব হাসাহাসি হয়ে ছিল। পরে বুঝেছি তিনি প্রায় ঠিক বলেছিলেন। কারণ জিনিস শব্দটা জিনিয়াস এর অপভ্রংশ হিসাবে ধরা যেতে পারে।
এক হাতে ঐশ্বরিক কলম অন্য হাতে নিজেকে নিরন্তর শাসন করতে করতে যাওয়া অভাবনীয় মুন্সিয়ানার মধ্যেই পড়ে। নিজেকে নিয়ে, বলা ভাল নিজের আকাশছোঁয়া প্রতিভা নিয়ে আত্মতুষ্ট থাকা তাঁর ধাতে ছিল না। শুধু রবীন্দ্রনাথ হয়ে জন্মালেই হবে না, তাকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠতে হবে। তিল তিল পরিশ্রম, ঘাম, রক্ত ঝরিয়ে নিজের সর্বোত্তম ক্ষমতাকে তুঙ্গতম প্রকাশিত করার নিবিড় প্রয়াস। একটা গোটা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিলে কতটা চাপ নিতে হয় ভেবে দেখা যেতে পারে।
একদিকে কবিতা লিখতে হবে নোবেল প্রাইজ পাবার মতো। আর আমরা প্যারডি করবো। গান লিখতে হবে মানুষের সব রকমের অনুভুতি নিয়ে। সুখে নৃত্য করার দুঃখে পাশে থাকার সব দায় কি তাঁর একার? বঙ্গজীবনের লক্ষ্য উপলক্ষ্য আদর্শ কর্তব্য শিক্ষা সমাজ রাজনীতি চর্চা নিয়ে তাঁকেই প্রবন্ধ লিখতে হবে? দিশা দেখাতে হবে?
তাঁকে উপন্যাস লিখতে হবে গোরামতো। আর আমরা প্রশ্ন তুলবো তার বাস্তবতা নিয়ে। তিনি নাটক লিখবেন রক্তকরবীর মতো। আমরা বলবো ঠিক নাটক করা যায় না এবং দুর্বোধ্য। তিনি আশ্রম করবেন। আমরা বলবো বিকৃত মানসিকতা। তিনি নাইটহুড পরিত্যাগ করবেন। অথচ গান্ধীজী বলবেন, আমাদের আরও ধৈর্য ধরা উচিত ছিল। ইংরেজদের এখনি এই নিয়ে বিব্রত করা ঠিক নয়।
তাঁর আনখশির প্রকৃতিময়তাকে আমরা ব্যাখ্যা করব, সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছেন বলে। দায়হীন বলে দেব তাঁর ইংরেজদের সঙ্গে মাখামাখি বেশি। তাঁর জাতীয়তার ধারনাটাকে আমরা আমাদের ছাঁচে ফেলে ঢালাই করে নেবো। চোখের সামনে মৃত্যু মিছিল দেখেও তাঁকে শান্ত থাকতে হবে। অকরুণ চলে যাবে বাবা মা স্ত্রী কন্যা পুত্র এমনকি নাতি অবধি। অথচ তিনি দীর্ঘ আশি বছরের পরমায়ু নিয়ে প্রথম দিনের মত ফলনশীল থেকে যাবেন আজীবন। কি মামার বাড়ির আব্দার একবার ভাবুন।


তাঁকে লেখা সব চিঠির উত্তর দিতে হবে সময়মতো। মিটিং মিছিলে অংশ নিতে হবে। সমাজ সংস্কার করতে হবে। দেশে বিদেশে বক্তৃতা দিয়ে বিশ্বভারতীর জন্য টাকা জোগাড় করতে হবে। স্ত্রীর গয়নাগুলো বেচে দিতে হবে। তাঁকে থেকে যেতে হবে অভিভাবকের মতো। আমরা তাঁকে কুৎসা নিন্দা আর অপমানে কালো করে দেবো বারবার।
তিনি ছবি আঁকলে বলে দেবো বর্ণান্ধ আর বুড়ো বয়সে আঁকলে এর থেকে ভাল কি হবে? ২৫শে বৈশাখের বিকেলবেলা স্টেজ কাঁপিয়ে খামচা খামচা করে আকাশের একোণ ওকোণ থেকে ধরে নিয়ে আসব রবীন্দ্র নৃত্য। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এর দেওয়ালে দেওয়ালে ঝুলিয়ে দেব পোস্টার কার্টুন আর আমোদকর খেউড়। দিগবলয় থেকে উড়ে আসবে সাদা কালো রঙিন বিভিন্ন জাতের রবীন্দ্র সংগীত। আমাদের সমবেত হৈ হুল্লোড় আর উদযাপনের মাঝে কোথায় তুমি কবি? আমাদের জপে যাপনে জীবনে কোথাও কি আছো? তুমি শুধু ২৫ শে বৈশাখ?





0/Post a Comment/Comments

নবীনতর পূর্বতন