সময় বদলায়। বদলাবেই। নিয়নের আলো ফিকে হয়ে এলইডি'র উজ্জলতায়। স্মার্টফোন মাপে রক্তচাপ। মুহূর্তগুলো বন্দি আজ আঙুলের ছোঁয়ায়। তবু ছুটির দিনে ক্লান্ত দুপুরে ভাতঘুম মন। শিরিষ গাছের দীর্ঘ ছায়া আড়মোড়া ভাঙে তপ্ত ছাদে। আর মন কেমন করা রবিবার দুপুরে মজে থাকে 'রোদ্দুরের কথকতা'।
কলমে-দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুক্লপক্ষ, ত্রয়োদশী তিথি। চৈত্র মাস। অনেক স্বপ্ন
সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে জন্মেছিলেন এক মহামানব। মা ত্রিশলার কোল আলো করে। ইক্ষাকু বংশের
রাজা সিদ্ধার্থর পুত্র হিসাবে। বর্তমান বিহারের চম্পারণ জেলার কুন্দলপুরে। তখন
মগধের রাজধানী বৈশালী। যীশুর জন্মাতে তখনও ৫৯৯ বছর বাকি। জৈন ধর্মের ২৪তম বা শেষ
তীর্থঙ্কর হয়ে বর্ধমান মহাবীর পৃথিবীতে এলেন।
বর্ধমান এর অর্থ যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এমন। তাঁর আর কী বৃদ্ধি
পাবে জ্ঞান ছাড়া। জীবন যাপনের সহজ সূত্র হিসাবে তিনি বললেন, নিজেকে জানো, নিজেকে
চিনতে শেখো এবং নিজের মধ্যে ডুবে যাও। তিনি ধর্মকে ব্যাখ্যা করলেন অনুভূতি দিয়ে।
তাঁর মতে নীরবতা ও আত্মসংযমই অহিংসা যা সর্বোত্তম ধর্ম। ঈশ্বর সেবা হয়ে উঠলো
জীবসেবারই নামান্তর।
যুদ্ধ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত, যুদ্ধ করতে হলে নিজের সঙ্গে
লড়াই করো, যে নিজেকে জয় করতে পারে সে সুখী ও আনন্দিত। তিনি অপছন্দ করতেন
যন্ত্রণাকে, অন্যকে যন্ত্রণা দিতেও। নীরবে পার হয়ে গেল তাঁর জন্মতিথি। হিংসা পরায়ণ ও পরস্পর যুযুধান মানুষের কাছে আজো
তিনি এক আলোকবর্তিকা। বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত। এই মরুভূমিতে
মরুদ্যানের মত।
১৯শে এপ্রিল সিনেমায় ঋতুপর্ণ ঘোষ দেখিয়ে ছিলেন এক শোক
সন্তপ্ত পরিবারের নানান টানাপোড়েন। যা একই সঙ্গে হয়ে উঠেছিল মনখারাপের জীবন্ত
দলিল। এবারের উনিশে এপ্রিল ছিল সেই রকমই এক শোকের পার্বণ। যুগ যুগ পালিত হয়ে আসছে।
‘শুভ শুক্রবার’ হিসাবে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা দেশে কোথাও ভালো কোথাও কালো
আবার কোথাও শুধুই ঈশ্বরের দিন। যীশুখ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার দিন। মহামানবের
দেহত্যাগের দিন। মানবতার লজ্জার দিনও বটে।
মানুষকে ভালোবাসার অপরাধে, নিজেকে ঈশ্বরের সন্তান বলার
অপরাধে সেই প্রথম মানুষের হাতে মানবতার সংগঠিত হত্যা। সমাজের মাথারা যখন যেন তেন
প্রকারেণ শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর, তখনও সেই যুগেও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন। শাস্তি
কেন? কি বা তাঁর অপরাধ? আজ সংখ্যাগুরু মানুষ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হলেও সেদিন
স্বয়ং যীশু সংখ্যালঘু ছিলেন। সেদিন সংখ্যাগুরু মানুষজনের চাপে রোমান গভর্নর
পন্টিয়াস পাইলেট হাত ধুয়ে নিয়েছিলেন। সমবেত জনতার সামনে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এই
হত্যালীলায় তাঁর কোন হাত নেই, দায় নে্ দায়িত্ব নেই।
চিরকাল এভাবেই শাসক হাত ধুয়ে নেয় সম্মিলিত গণহত্যার কলঙ্ক
থেকে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে দেশে দেশান্তরে। দুর্বলের উপর লঘুর উপর যে কোনো
ছুতোয় সবলের গুরুতর অত্যাচার। গণহত্যা নরহত্যা বিভিন্ন ছলে। বহুমাত্রিক ব্যাখ্যায়।
নব বৎসরে এই আঁধি লাগা দিনে কি ভীষণ প্রাসঙ্গিক এই দুই নরোত্তম পুরুষ। আমরা শুনি
তাঁরা বারবার আসেন মানবতার জয়গানে মুখর হবার জন্য। বিশ্বাস শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়
জেগে উঠবেন বলে।
ভাবীকালের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে হয়তো তখন আবার আমরা এইরকম অন্যায় হত্যার
গৌরবময় উদযাপনে সামিল হব। আর সেই অবনত লজ্জার ম্লানিমা নিয়ে শুনতে পাবো
রবীন্দ্রনাথের বিনম্র উচ্চারণ ‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো,
সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো, পাগল ওগো ধরায় আসো’। আজকের ভারতবর্ষে কোন টাইমমেশিনে চেপে
ওঁরা যদি এসে মুখোমুখি হতেন কী লজ্জা হতো বলুন দেখি? এখনো সময় আছে ত্রুটি সারিয়ে মানুষের
মুখে হাসি ফোটানোর। এখনো চেষ্টা করলে খানিকটা মুছে দেওয়া যায় অপমানিতের ব্যথা ও
বেদনা। গ্লানি ধুয়ে, জরা ঘুচিয়ে এই অগ্নিস্নাত প্রবীণ ভূখন্ড যদি আবার নবীণ হয়ে ওঠে
তাহলে ক্ষতি কী? মাভৈঃ।।