রোদ্দুরের কথকতা- শিব ঠাকুরের আপন দেশে

সময় বদলায়। বদলাবেই। নিয়নের আলো ফিকে হয়ে এলইডি'র উজ্জলতায়। স্মার্টফোন মাপে রক্তচাপ। মুহূর্তগুলো বন্দি আজ আঙুলের ছোঁয়ায়। তবু ছুটির দিনে ক্লান্ত দুপুরে ভাতঘুম মন। শিরিষ গাছের দীর্ঘ ছায়া আড়মোড়া ভাঙে তপ্ত ছাদে। আর মন কেমন করা রবিবার দুপুরে মজে থাকে 'রোদ্দুরের কথকতা'। 

কলমে-দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়

 বর্ষ চক্র পৃথিবী পরিক্রমা শেষ করলো এবারের মতো। একটু কি ক্লান্ত?  জিরোনোর দরকার। সুরুলের মেলায় এক মহান পাগল বলেছিল, সূর্য চন্দ্র ঠিকঠাক ঘুরছে তো? আমাকে কেউ কিছু জানাচ্ছেন না। পরে আটকে গেলে, আমাকে বলবেন না। এই বিপুল বিরাট মহাবিশ্বে অসংখ্য গ্রহ তারা কার যে অঙ্গুলিনির্দেশে চলে কে জানে! কেউ জানলে আমাকে একটু খবর দেবেন। পরে আটকে গেলে... । চৈত্র মাসের আকাশ। খররোদে ফুটিফাটা মাঠ। বাইরে হলকা হাওয়া। এই রকম উদ্ভ্রান্ত দিনে প্রতি বছর নীল ষষ্ঠী হয়। আমার মনে পড়ে মা এর নীলের উপবাস। তপঃ ক্লিষ্ট মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তৃপ্তি।
যা পূন্যের পূর্ণতার সমার্থক। বাবা রামনাথ ও তাঁর চতুর্দোলা। গ্রাম পরিক্রমা। সঙ্গে ভক্ত দল। এই ছবি চরকতলার টাঙানো সামিয়ানার সাথে এক অনুসংগ। এই ব্রত উদযাপন গ্রাম বাংলার নিজস্ব চাওয়া পাওয়ার সাথে লীন। কথিত আছে এই দিন পশুপতি শিবের বিবাহ হয় লীলাবতী র সঙ্গে। চৈত্র সংক্রান্তির পূর্ব দিনে  ষষ্ঠী না হলেও নীল ষষ্ঠী ব্রত আটকাতে পারে না। তবে গাজন শুরু আর ও তিনদিন আগে থেকে। চৈত্র মাসের ধর্ম উৎসব। উপলক্ষে মহাদেব শিব। রামচন্দ্র  অকালবোধন না করলে যে সময় মায়ের পুজো হত তার গায়ে গায়েই। মালদহে এই উৎসবের নাম গম্ভীরা। শিবের প্রীতি কামনায় সন্ন্যাস গ্রহণ।মালদহে রাজা দ্বিতীয় ধর্মপালদেব ও গোবিন্দ চন্দ্র দেবের আমলে ধুমধাম করে গাজনের চল ছিল। শিব সংহিতা বলে শিবের আর এক নাম গম্ভীর। সেন রাজাদের উৎসাহ ছিল খুব এই উৎসবে ও আচারে। আগামী কাল শুরু হবে নববর্ষ। আর  যা কিছু জীর্ণ, পুরাতন, পচা ও গতানুগতিক তা মুছে ফেলে নব উৎসাহে নতুন বৎসরকে বরণ করে নিতে হবে। কীভাবে? ত্যাগ তিতিক্ষা আর কৃচছসাধনের মধ্য দিয়ে। এই বিলয় ও ত্যাগের প্রধান দেবাদিদেব আশুতোষ। তিনি অল্পে তুষ্ট কিন্তু কঠোর। কত প্রচেষ্টা তাঁকে খুশি রাখার। উঁচু বাঁশের বা খুঁটির মাথায় বাঁধা দন্ডে ঘূর্ণন উৎসব। এই খুঁটির অন্য নাম চড়কগাছ। এখানে সন্ন্যাসী মানে ভক্ত। অষ্টাংগ বাণ ফুঁড়ে ভক্ত ঘুরছে। কঠোর তিতিক্ষা। বর্ধমান আর বাঁকুড়া জেলার সীমান্তে চাকতেতুঁল গ্রাম।বাবা রামেশ্বর এর সম্মানে মহোৎসব। রণডিহা, কসবা ইত্যাদি গ্রামে গ্রামাঞ্চলে ভক্তি অটুট। চলমান। ঘোর কলিকাল। তবু এই ভোগান্তির শতাব্দী কিছুক্ষণের জন্য মুখ লুকিয়ে থাকে। ভক্ত বৃন্দ  আকুল। উপবাস হবিষ্যের কঠোর কৃচ্ছসাধন। বেলকাঠের এক বিরাট টুকরো লগ এখানে বাণেশ্বর। তাঁর গায়ে অজস্র পেরেক ত্রিশূল। প্রধান ভক্ত বা পাট ভক্ত সেই বাণেশ্বর মাথায় নিয়ে চলেছেন বিভিন্ন পূজা স্থানে। তাকে অনুসরণ করছে ভক্ত দল। উৎসাহী গণ ও গণতন্ত্রের নিষ্ঠ উপাসকরা। বিরাট শলাকা জিভ ফুঁড়ে বেরিয়েছে পাশাপাশি। এই রকম বাণ ফুঁড়ে প্রায় শতাধিক ভক্ত শিবের নাম নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
ঠাকুরের মহিমা গানে মুখরিত চারদিক। ভোর বেলা ভক্তরা জাগিয়ে এসেছেন তিনচারটি মৃতপ্রায় কদমগাছ বাবার নামে। সন্ধ্যা বেলা সেই গাছেই ফুটে উঠবে অপার্থিব কদম, এমন অসময়ে। শ্রীকৃষ্ণের এই প্রিয় ফুল ছাড়া রামেশ্বরের  পুজো সম্পূর্ণ হয় না। পূর্ণেন্দু পত্রী তাঁর সোনার মেডেল কবিতায় লিখেছেন, বাঁজা গাছে বাজিয়ে দিলুম ফুলের ঘুঙুর। এখানেও সেইরকম। বাবা রামেশ্বরের মহিমায় উজ্জ্বল জনপদ। ভক্ত কুমোরপুকুরে ছড়িয়ে দিল কড়ি। সেই কড়ি আশ্চর্য কোমলতায় পুকুরের জল তোলপাড় করে ঢুকে পড়ল ভক্তের মাটির কলসীতে। সেই উল্টো করা কলসী মাথায় নিয়ে একফোঁটা জল মাটিতে না ফেলে ভক্ত টলতে টলতে মন্দিরে এসে নিবেদন করে। চড়ক গাছের উপর থেকে বহু নীচে শান দেওয়া অস্ত্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। এই দৃশ্য বিস্মিত দর্শককে আকুল করে তোলে বাবা রামেশ্বরের জয়গানে ।অর্থী প্রার্থী আতুর মানুষের বেঁচে থাকার রসদ দিয়ে মহাদেব নির্বিকার, অবিচল। অনন্ত  অসীমের পথে হেঁটে যায় মানুষ। পথের ধুলো উড়িয়ে। তিনি ও উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে পথে বাহির হয়েছেন। মহাকাল বয়ে যায় নববর্ষের দিকে।পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা অজস্র ছাতাহীন মানুষের মাথায় আশ্বাস ও আশা দিয়ে।তারাশংকরের নীলকণ্ঠের  পুজোয় এবারে আবার কে চন্দ্রাহত হয়ে গেল কে জানে। খুঁজে দেখা দরকার। বাবার মহিমা বিফল হবার নয়।আমি খুঁজতে বেরিয়েছি। মাথার উপর গনগনে সূর্য সাক্ষী করে। লয়ের দেবতা আগামী সৃষ্টি ও স্থিতিকে নিশ্চয় রক্ষা করবেন নববর্ষে। নবভারতে।

1/Post a Comment/Comments

Unknown বলেছেন…
Excellent......outstanding
নবীনতর পূর্বতন