রোদ্দুরের কথকতা- প্রতীক্ষায় বাঁচে বসন্ত

সময় বদলায়। বদলাবেই। নিয়নের আলো ফিকে হয়ে এলইডি'র উজ্জলতায়। স্মার্টফোন মাপে রক্তচাপ। মুহূর্তগুলো বন্দি আজ আঙুলের ছোঁয়ায়। তবু ছুটির দিনে ক্লান্ত দুপুরে ভাতঘুম মন। শিরিষ গাছের দীর্ঘ ছায়া আড়মোড়া ভাঙে তপ্ত ছাদে। আর মন কেমন করা রবিবার দুপুরে মজে থাকে 'রোদ্দুরের কথকতা'। 

কলমে-দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়


আবীর ছড়িয়ে দাও আকাশে। সেই রঙ লাগুক গায়ে। পূর্ণচাঁদের মুগ্ধ মায়া ভরে দিক অন্তরতর অন্ধকার। জীবনের গায়ে লাগুক সুবাতাস। জীর্ণ ক্লান্ত দেহকে সাজিয়ে নাও আগামীর প্রতিশ্রুতিতে। পরিস্রুত জল আর সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে সঙ্গে রাখো। যন্ত্রণাকে পরিবর্তিত করো প্রাপ্তিতে। প্রতিদিন সাপলুডো খেলা চলে। ভাবি জিতছি আমি, আসলে মহাকাল। তুমুল  বর্ণবিপর্যয় শেষে প্রারব্ধের ক্ষয়। বাড়িঘর পয়ঃপ্রনালী রাস্তাঘাট সব রঙিন। ফানুস উড়ে যায় ছিটিয়ে শান্তিজল। ম্যাড়মেড়ে আলো রঙিন কাগজ জড়িয়ে উৎসব করো। পোকামাকড় কৃমি কীটের অবিমিশ্র যৌনতায় দিন দিন বাঁচো। রক্তাল্পতায় ভোগা শীর্ণ রমণী ভীরু হতবাক চাহনিতে ঢাকতে পারে না চোখের তলার কালি। রাংঝাল দেওয়া ভালো ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্কে। সন্দেহ আর অবিশ্বাস যেন কুড়ে কুড়ে খায়। 
শিকড়ে ধারালো দাঁত চালায় মেঠো ইঁদুর। স্টেশনে স্টেশনে টাঙিয়ে দাও শ্বেতপতাকা। আর কতদিন যুদ্ধ করবে মানুষ। মৃত্যু যদি চরম সত্য হয় স্বাধীনতা কেন পরম প্রাপনীয় হবে না। জীবনের একটা সুনির্দিষ্ট অর্থ ও উদ্দেশ্যের খোঁজে কেন ভূমধ্যসাগরে একলা তরণী বাইবো না। এইসব অগনিত মিছিলের মুখ। মুখ নয় মুখোশের মিছিল। নিরাপত্তার মতো অলীক স্বপ্নময় শব্দেরা আশ্বস্ত করে। পিলপিল করে বেরিয়ে আসা গুবরে পোকারা ঢেকে দেয় আমার দেহ। তারপর আয়নায় দেখি মুখে কঙ্কালের হাসি। অভূতপূর্ব অচিন্তনীয় অনুভূতির মতো। গোমড়ামুখো আকাশ। এখুনি বৃষ্টি নামবে লালমাটির উপর। প্রতীক্ষায় থাকা সযত্নে। সাময়িক নিভে যাবে কৃত্রিম নিয়ন আলো। শোভন লোভন বিজ্ঞাপন দুমড়ে গিয়ে আপাত বিশৃঙ্খলা ঘিরে দেবে। দ্রুত সারিয়ে নেওয়ার আগে মুহুর্মুহু ব্জ্র বিদ্যুতে চমকিত হবে অন্ধকার জনপদ। প্রাকৃতিক বিরক্তির অনুষঙ্গে। ভিজে সোঁদা মাটি ছাতিম গন্ধে মিশে কিছুক্ষণের জন্য ফিরিয়ে দেবে পূর্বজন্মের বাল্যকাল। 
সেই কালো মেদুর বসন্তে উত্তরায়ণের খোলা বাতায়ণে জানালা শার্সিতে ঝোড়ো হাওয়া রেখে যাবে কোনো পান্ডুর পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ। কোণার্ক উদয়ন পুনশ্চ উদীচীর গায়ে গায়ে হাহাকার শোনা যাবে মানুষের মূর্খতার আত্মঘাতের অপ্রাপ্তির। শ্যামলীর ভাঙা কার্নিশে মাথা দোলাবে কোনো আগামী বটবৃক্ষের কচিপাতা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগে। ভাড়াটে পুলিশের নির্ভেজাল নজরদারী আর পথ কুকুরের কুণ্ডলীকৃত দেহের পাশ দেবে উঁকি দেবে গুটখা শোভিত দেওয়াল। কালীসায়রের পাড়ে গড়াগড়ি দেবে ছোটো বড় বিভিন্ন মাপের শিশি বোতল। উড়ন্ত এঁটো শালপাতায় লেগে থাকবে ঘুগনি চাট আর ঝাল মটরের ভুক্তাবশেষ। যত্রতত্র মুখ ব্যাদান করে থাকবে থার্মোকলের থালা। এই সব পাশ কাটিয়ে সাবধানে গিয়ে বসতে হবে কাচঘরের বারান্দায় ছাতিমতলায়। যেখানে ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম মনের আনন্দ আত্মার শান্তি’। শালবনে লেগে যাবে মাতন। ন্যাড়াপোড়ার বহ্নূৎসবে ছাই হয়ে যাবে অশুভ আকালের দিন। 
প্রান্তিকের দিক থেকে ক্যানেলের কিনার ঘেঁসে বল্লভপুরের মাটির গন্ধ বুকে নিয়ে কিছু টাটকা বাতাস ছুটে আসবে। মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে দেবে টুরিস্ট মোটর। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ এসে যাবে নিশ্চয়। তখন আবার চেনা অচেনা ভীড়ে আমরা হারিয়ে যাবো। তার আগে বসন্তের এপিটাফে লিখে রাখি মৃতপ্রায় বাটিক শিল্পের কথা। নকশীকাঁথায় গল্প বলে খোয়াই। ভুবন নামে যে ডাকাতের নামে ভুবনডাঙ্গার মাঠ তাকে ডেকে এনে দেখাতে ইচ্ছে করে কিভাবে শিল্প আর সংস্কৃতির নামে গোটা শান্তিনিকেতন লুঠেরারা দখল নিচ্ছে। আশ্রমিকদের ক্ষোভ প্রতিবাদ আবেদন সবই মিলিয়ে যায় হট্টমেলায়। তবু বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না। সুস্থ রুচি আর সুস্থতার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন বাদে এবারে মঞ্চায়িত হল চিরকালীন গীতিনাট্য ‘সুন্দর’। সব ছাপোষা গৃহগত প্রাণ বঙ্গবাসীর উদ্দেশ্যে কবি কতদিন আগে বলেছিলেন, বাইরের রঙ যেন আমাদের মনে লাগে আমাদের সকল কাজে লাগে। ‘কাঁদন বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে, বিশ্ব নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে’ তেমন করে কে রাঙিয়ে দিয়ে যাবে আমায়?  

0/Post a Comment/Comments

নবীনতর পূর্বতন