সময় বদলায়। বদলাবেই। নিয়নের আলো ফিকে হয়ে এলইডি'র উজ্জলতায়। স্মার্টফোন মাপে রক্তচাপ। মুহূর্তগুলো বন্দি আজ আঙুলের ছোঁয়ায়। তবু ছুটির দিনে ক্লান্ত দুপুরে ভাতঘুম মন। শিরিষ গাছের দীর্ঘ ছায়া আড়মোড়া ভাঙে তপ্ত ছাদে। আর মন কেমন করা রবিবার দুপুরে মজে থাকে 'রোদ্দুরের কথকতা'।
কলমে-দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘কাল থেকে মনে মোর লেগে আছে খটকা, চিটেগুড় কিসে দেয় সাবান
না পটকা’ এই প্রশ্ন আমারও হয়। বহু প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। কিছুই সমাধান হয় না।
না হোকগে। কে মাথার দিব্যি দিয়েছে। কিন্তু এই যে দুমদাম লোক বেঘোরে মরে যাচ্ছে এর
তো একটা বিহিত হওয়া দরকার। কোনো কারণ ছাড়াই। উদ্দেশ্যবিহীন।
ভগবান বললেন ‘আমি লোকক্ষয়কারী কাল। অর্জুন তুমি চিন্তা কোরো
না। আমি এদের আগেই সংহার করে রেখেছি। তুমি নিমিত্ত মাত্র। যুদ্ধ কর।’ তাহলে একমাত্র উপার্জনকারী শহীদ সৈনিকের
পরিবার পরিজনদের আমরা কি এই সান্ত্বনা দেব? রাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য পূরণে বারবার
যৌবন এইভাবে বলি হবে। মৃত্যুমিছিল আর মারের বদলা মার।
সেই মহাভারত থেকে আমরা দেখে আসছি- ভাইয়ের সঙ্গে, নিজের
দেশের মানুষের সঙ্গে বৈরিতা। আসলে একটা যুদ্ধের আবহ বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তাহলে অনেক
সমস্যা লঘু হয়ে যায় যুদ্ধের কাছে। যেগুলি দরকারী, মানুষের রুটি রুজির সঙ্গে
ওতপ্রোত ভাবে জড়িত সেগুলো চলে গেল পিছনের সারিতে। প্রতিটি রাজ্য একে অন্যের সঙ্গে
নিজের লুকোনো কর্মসূচী, সুযোগ সুবিধা পাওনাগণ্ডা নিয়ে রাজনীতি করে চলেছে। একটা
গোটা ভারতবর্ষের স্বপ্ন কি তাহলে অলীক? অবাস্তব। বিচ্ছিন্নতাকামী সন্ত্রাসবাদীদের
সর্বশক্তি দিয়ে মূলোৎপাটন করা দরকার। দেশ নিশ্চয়ই তার দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন।
এই বিপুল বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর প্রতিটি মানুষ যেন একটু
স্বস্তি পায়। তাদের ভাবনায় যেন আসে, আমার দেশ আমাদের রক্ষার ব্যাপারে যত্নশীল। সেই
সঙ্গে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে আমাদের বাড়ির ছেলে মেয়েরাই দেশরক্ষার কাজে
বিভিন্ন বাহিনীতে অতন্দ্রপ্রহরী। তাদের ঘাড়ে বন্দুক দিয়ে আমরা যদি শুধুমাত্র
ঘরেবাইরে ট্রেনে বাসে কাগজপত্রে,
গণমাধ্যমে সামাজিক মাধ্যমে উস্কানিমূলক মন্তব্য ও দেশপ্রেমের পরমতম প্রকাশ ঘটিয়ে
দেশের চরমতম সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেললাম।
পরমাণু যুদ্ধ সারা পৃথিবীর পক্ষেই ভয়ংকর। যুদ্ধের সঙ্গে
অনুগত ভৃত্যের মত আসে মারী ও মন্বন্তর। একটা সর্বাঙ্গীণ উদ্বেগ ছড়িয়ে থাকা অবস্থা
থেকেও আমাদের চেষ্টা করতে হবে বেরিয়ে আসার। যাতে আবার আমরা সমাজের মূলস্রোতের
ভাবনায় ফিরতে পারি। ভালবাসায়, ভালো থাকায়, ভালো রাখায় ফিরতে পারি। শত শতাব্দী
লাগলেও বইয়ে দিতে হবে আমাদের বুকের গভীরে থাকা সেই ছোট্ট ঝিরঝিরে নদীকে সব প্রাণে।
যার তিরতিরে বয়ে যাওয়া শুধু একা একা টের পাওয়া যায়। যে পেরিয়ে যায় সব সীমান্ত আর
কাঁটাতার, যার জলধারা বিপন্ন মানুষের আতঙ্কিত হৃদয়ে সুদিনের গল্প শোনায়।
এক মশাল থেকে আর এক মশালে আগুন কিভাবে এগিয়ে যায় দ্যাখো। গুজব আর সন্দেহ দুই
বিষবৃক্ষ কিভাবে ডালপালা ছড়ায় পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামান্তরে। তারপর সে গ্রাস
করে নেয় দেশ কাল জনপদ। ‘যারা যায় তারা চলে যায়। যারা থাকে তারাই জানে কিভাবে হাতের উলটো পিঠে কান্না
মুছে হাসতে হয়।’ তাদের পরিবারগুলো ভেসে যায়। তাদের সন্তানদের সুষ্ঠু পড়াশোনা ও
বিকাশ কিভাবে হবে? তারা কি দেশে দেশে হারিয়ে যাবে অন্ধকূপে। এগিয়ে যাবে এক শূন্য
থেকে আর এক শূন্যতার দিকে। ঘৃণা, হতাশা আর তাড়া খাওয়া ভবিষ্যতের দিকে। আর আমরা
আমাদের মুষ্টিমেয় আপাত নিরাপদ ডালভাত ছাদ নিয়ে চোখ বুজে থাকব? প্রতি হাতে কাজ,
ক্ষুধার্ত মুখে একটু ভাত, সমৃদ্ধি আর বিকাশের দিকে চির আগুয়ান দেশ আমাদের সবারই
কাম্য হওয়া উচিত। তাতেই সবার মঙ্গল।